গরমের দিনে সাবুদানা একটি দুর্দান্ত খাবার। আয়ুর্বেদ অনুসারে, ঔষধি সাবুদানা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। সাবুদানা প্রোটিনের একটি ভালো উৎস এবং পেশী বিকাশকে সহায়তা করে। সাবুদানা ফাইবার, ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ এবং এনার্জি বুস্টার হিসাবেও পরিচিত।
সাবুদানা দেখতে সাদা মুক্ত দানার মতো ছোট ছোট দানা। সাগুদানাকে ইংরেজিতে “সাগু পার্ল” বলে। সাবুদানা ট্যাপিওকার শিকড় থেকে নিষ্কাশিত একটি স্টার্চ। যাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট।
সাবুদানা প্রথমে ১১৭০ সালে চীন দেশে তৈরি হয়েছিল। প্রাচীনকালে সাবুদানা রোগী বা বাচ্চাদের খাবারের তালিকায় থাকলেও বর্তমানে সাবুদানাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সাবুদানার রেসিপিগুলোর মধ্যে সাবুদানা পাঁপড়, সাবুদানার খিচুড়ি , সাবুদানার বড়া, সাবুদানার ক্ষীর ইত্যাদি অন্যতম। ইংল্যান্ডে মিষ্টি দুধের পুডিং এবং নিউজিল্যান্ডে লেবুর সাগু পুডিং খাওয়া হয়।
সাবুদানা প্রধানত উৎপাদিত হয় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও ভারতে। তবে চীনারা এখন সাবুদানা ময়দা আমদানি করে নানা বর্ণের ও নানা আকারের সাবুদানা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে।
এক প্রকার পাম গাছ থেকে সাবুদানা উত্পাদিত হয় যার বৈজ্ঞানিক নাম মেট্রোজাইলন সাগু। লম্বায় ৭ থেকে ১৭ মিটার পর্যন্ত হয়। কখনো কখনো ২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছে ২০-২৫ টির মত পাতা হয়। এটি একটি ঔষধি গাছ, এতে একবারই ফুল ফোটে এবং ফল ধরার পর গাছ মারা যায়।
সাবুদানা পাওয়া যায় পাম গাছের কান্ডের ভেতরে। গোল দানাদার আকারে নয়। ৭ থেকে ১৫ বছর বয়সে যখন সাবুদানা গাছে ফুল ধরার সময় হয়, তখন গাছ কেটে এর কান্ডকে চিড়ে ফেলা হয়। এরপর এর কান্ডের ভেতরের নরম “পিথ”কে ধারাল কিছু দিয়ে কুপিয়ে আলাদা করা হয়। এরপর একে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এর ভেতরের স্টার্চ পানির নিচে জমা হয়। পানি থেকে আলাদা করে এই সাদা রঙের স্টার্চকে শুকানো হয়। শুকিয়ে নিলে এটাকে বলে সাবুদানার ময়দা। একে এভাবেই খাওয়া যায়। তবে এই ময়দা আকারে সাবুদানা সাধারণত আমরা খাই না। আমরা যে সাবুদানা খাই তা মেশিনে সাবুদানার ময়দা থেকে ছোট ছোট দানা আকারে তৈরি করা হয়। একটি পূর্ণ গাছ হতে ১৪০ থেকে ৩৫০ কেজি পর্যন্ত সাবুদানা পাওয়া যেতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এক কাপ সাবুদানায় রয়েছে ৫৪৪ ক্যালোরি, ১৩৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১.৩৭ গ্রাম ফাইবার, ০.২৯ গ্রাম প্রোটিন, ০.০৩ গ্রাম ফ্যাট, ৩০.৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং অল্প পরিমাণে আয়রন, পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম। এবার জেনে নেওয়া যাক সাবুদানা খাওয়ার কিছু উপকারী গুণাবলী-
হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়
সাবুদানা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়। রক্তের কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের উচ্চ মাত্রা হলো হার্টের রোগের কারণ। সাবুতে উচ্চ পরিমাণের মিলস রয়েছে যা এক ধরণের শর্করা। এমিলস লিনিয়ার চেইনযুক্ত এক প্রকার গ্লুকোজ যা হজম হতে বেশি সময় নেয়। চেইনগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথে তারা নিয়ন্ত্রিত হারে চিনি ছেড়ে দেয়, যা আপনার কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ঠিক রাখতে পারে। ফলে সাবুদানা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়।
দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা আমাদের শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ফ্রি র্যাডিক্যাল আমাদের দেহে বৃদ্ধি পাওয়া মানে, সেলুলার ক্ষতি যা ক্যানসার এবং হার্টের রোগের জন্য দায়ী। টেস্টটিউব সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ট্যানিন এবং ফ্ল্যাভানোয়েডের মতো পলিফেনল সাবুদানাতে পরিমাণে বেশি থাকে। যা আমাদের দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে।
সাবুদানা খেলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়
রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ (প্রতিরোধী শর্করা) রয়েছে। সাবু দানাতে প্রায় ৭.৫% রেজিস্ট্যান্ট সার্চ (প্রতিরোধী শর্করা) রয়েছে। রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ। (প্রতিরোধী শর্করা) যা হজম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, কিন্তু হজম হয় না। প্রতিরোধী স্টার্চ কোলনে পৌছায় এবং অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার খাবার হিসাবে কাজ করে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রতিরোধী স্টার্চ ভেঙে দেয় এবং সংক্ষিপ্ত-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো যোগ তৈরি করে। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিরোধী টার্চ এবং এসসিএফএ রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে আনে, ক্ষুধা হ্রাস এবং হজমের জন্য ভালো। সাবুদানাতে আঁশ থাকার জন্যে এটি আমাদের পৌষ্টিক নালীকে পরিষ্কার রাখে, পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের মতো সমস্যাগুলোকে দূরে রাখে।
স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল পেতে সহায়তা করে
সাবুদানা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল পেতে সহায়তা করে । সাবুতে থাকা বিশেষ প্রোটিন অকালে চুল ঝরে পড়া রোধ করে, নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে, খুশকির হাত থেকে রক্ষা করে, এমনকি চুলের বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণ করে ।
হাড় মজবুত করে
সাবুদানাতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় । তাই বাচ্চা বা বয়স্কদের নিয়মিত সাবুদানা খাওয়ালে যেমন হাড় মজবুত হয় তেমনি হাড়ের ঘনত্বও বাড়ে । এইকারণে সাবুদানা খেলে অস্টিওপোরোসিসের মতো হাড়জনিত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায় ।
কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে
সাবুদানা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে সাবুদানা শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ৮ জন। সাইক্লিস্টদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ব্যায়াম করার সময় সাবুদানা গ্রহণ করায় ব্যায়াম করার শক্তি ৩৭% বৃদ্ধি পেয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্যায়াম করার পরে সাবুদানা গ্রহণ দেহের শক্তি পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ব্যায়ামের আগে বা পরে সাবুদানার মতো কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যায়, তাহলে শরীর চাঙ্গা থাকে। ব্যায়ামের পরে শরীরের ক্লান্তি দূর করতেও সাবুদানার মতো খাবার খুব দরকারি।